Ads

 

বাংলাদেশে চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা ও চিংড়ি চাষ পদ্ধতি 

বর্তমানে বাংলাদেশে যেসকল চিংড়ি চাষ পদ্ধতি প্রচলিত আছে সেগুলোকে চাষ ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন, মজুদ হার ইত্যাদির ভিত্তিতে প্রধানত ৪টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

  1. সনাতন চাষ পদ্ধতি (Extensive System):
  2. উন্নত হালকা চাষ পদ্ধতি (Improved Extensive System);
  3.  আধা-নিবিড় চাষ পদ্ধতি (Semi-Intensive System);
  4. নিবিড় চাষ পদ্ধতি (Intensive System)।

নিয়ে উপযুক্ত পদ্ধতিগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-

(১) সনাতন চাষ পদ্ধতি : সনাতন পদ্ধতি সবচেয়ে সহজ চাষ প্রথা। এ পদ্ধতি সবচেয়ে পুরাতন, কম পুঁজি এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ। এ চিংড়ি চাষ পদ্ধতি প্রকৃতির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এ পদ্ধতির চাষে কোনো বাড়তি খাবার দেওয়া হয় না । বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে প্রাচীনকাল থেকেই এ প্রথা প্রচলিত রয়েছে। এ পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্ত চিংড়ি চাষের পুকুর পরিকল্পিত উপায়ে নির্মিত হয় না। পুকুরের আয়তন ২০ হেক্টরের বেশি হয়ে থাকে। পুকুরের বাঁধ নিচু, পানির গভীরতা ০.৩ থেকে ১.২ মিটার, তলদেশ অসমতল ও নিষ্কাশনযোগ্য খাল নেই, পানি ব্যবস্থাপনা অনিয়মতান্ত্রিক, রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা হয় না। এ পদ্ধতিতে চাষ চলাকালে কোনো বাড়তি খাবার দেওয়া হয় না। সাধারণত প্রতি হেক্টরে ১০ থেকে ১৫ হাজার পোনা মজুদ করলে হেক্টরপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ কেজি চিংড়ি উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ ব্যবস্থায় চিংড়ির সাথে অন্যান্য মাছও আবাদ হয়ে থাকে। বাংলাদেশের খামারগুলোর ৮৫% থেকে ৯০% এ পদ্ধতির মধ্যে পড়ে।

(২) উন্নত হালকা চাষ পদ্ধতি : এ জাতীয় চাষ পদ্ধতিতে খামারের জন্য নির্দিষ্ট নকশা প্রণয়ন করে চাষের জন্য পুকুর, পানি নিষ্কাশনের জন্য খাল ইত্যাদি পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়। পানি ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ত সুবিধাসহ প্রয়োজনে পাম্প ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়। নিয়মিত জৈব ও অজৈব সার এবং প্রয়োজনে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা হয়। এ পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি ৩০ থেকে ৪০ হাজার পোনা মজুদ করে। ২০০ থেকে ৫০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ চাষ পদ্ধতিতে মধ্যম ধরনের পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয় এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ। এ পদ্ধতিতে মাটি ও পানির উন্নয়নের জন্য চুন ও সার প্রয়োগ, রাক্ষুসে ও ক্ষতিকর প্রাণী নিয়ন্ত্রণ, আগাছা দমন ইত্যাদি করা হয়।

(৩) আধা নিবিড় চাষ পদ্ধতি : এক্ষেত্রে পুকুরের আয়তন ছোট (০.৫.১ হে.) হয়ে থাকে। তলদেশ সমতল, একদিকে ঢালু এবং পানি সম্পূর্ণ নিষ্কাশনযোগ্য। পরিকল্পিত রাক্ষুসে প্রাণী নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নতমানের পিলেট খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থাদি। বিদ্যমান। এ সমস্ত খামারের হেক্টরপ্রতি ২ থেকে ৩ লক্ষ পোনা মজুদ করে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এ প্রকার খামারে বর্তমানে প্রতি বছরে হেক্টর প্রতি ৪ থেকে ৫ টন চিংড়ি উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে কক্সবাজার এলাকায় চিংড়ি ফার্মে এই পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের জন্য অধিক দক্ষ জনশক্তি ও মেশিনের সাহায্যে পুকুরে • পানি ও অক্সিজেন সরবরাহ করা হয় এবং পুকুরের তলদেশের কাদা পরিষ্কার করা হয়।

(৪) নিবিড় চাষ পদ্ধতি : নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ বেশ ব্যয়বহুল। বিশ্বের অনেক দেশে এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ চালু থাকলেও আমাদের দেশে তেমন ব্যাপকভাবে শুরু হয় নি। এধরনের চাষ পদ্ধতিতে চুন ও অন্যান্য রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে খামারে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন করা হয়। তাছাড়া খামারে বিশুদ্ধ পানি এবং উন্নতমানের পিলেট খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এ পদ্ধতিতে খামারে আয়তন এক হেক্টরের চেয়ে কম হয় এবং প্রতি বর্গমিটারে ১৫টির মতো পোনা মজুদ করে ৫-১০ টন চিংড়ি উৎপাদন করা হয়। নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে পুকুর বা খামার নির্মাণ থেকে শুরু করে চিংড়ি আহরণ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নজর রেখে চলতে হয়।

বাংলাদেশে চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চিংড়ি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এদেশের রপ্তানিজাত মৎস্য পণ্যের প্রায় ৬৫% চিংড়ি। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটি চিংড়ি চাষের জন্য অনুকূল। আমারে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে চিংড়ি চাষ ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিংড়ি চাষের সম্ভাবনার দিকসমূহ নিচে

তুলে ধরা হলো-

সময় পৃথিবীতে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের চিংড়ি আমদানিতে আগ্রহী।

২) বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি ও পানি চিংড়ি চাষের জন্য খুবই অনুকূল।
৩) এদেশের প্রাকৃতিক উৎস থেকে সহজেই চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করা যায়।

8) আমাদের দেশে রপ্তানি বাণিজ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের পরেই চিংড়ির অবস্থান।

৫) বর্তমানে চিংড়ি থেকে রপ্তানি আয় মোট জাতীয় আয়ের ৭.৮%।

৬) ১৯৯৭/৯৮ সালে বাংলাদেশে চিংড়ি রপ্তানি করে আয় করেছে ১১৮২ কোটি টাকা।

৭) কৃষক পর্যায়ে স্বল্প ব্যয়ে ও ক্ষুদ্র আয়তনে চিংড়ির খামার করা যায়।

৮) চিংড়ির সাথে অন্যান্য অর্থকরী কার্প জাতীয় মাছ চাষ করা লাভজনক।

৯) চিংড়ির খামার সামান্য বিনিয়োগেই তৈরি করা যায় ।

১০) উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৩০% জমিতে বর্তমানে সারা বছর চিংড়ি চাষ করা হয়।

১১) এদেশে চিংড়ির চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়িয়ে অতি সহজেই পতিত জমি পুনরুদ্ধার সম্ভব।

১২) বাংলাদেশের ৪৮০ কি.মি. বিস্তীর্ণ উপকূল এবং ২০০ নটিকল মাইল পর্যন্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে রয়েছে চিংড়ি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা।

১৩) এসব অঞ্চলে সনাতনী পদ্ধতিতে চাষের মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি ১৮০-২০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদিত হচ্ছে উন্নত

পদ্ধতিতে চাষ করলে এ উৎপাদন বেড়ে ২ থেকে ৩ গুণ করা সম্ভব।

১৪) কক্সবাজার অঞ্চলে লবণের সাথে চিংড়ি এবং খুলনা অঞ্চলে চিংড়ির সাথে ধানের চাষ করা হয়।

১৫) বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১,৪০,০০০ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এর মাঝে খুলনা অঞ্চলে ১,১০,000 হেক্টর ও কক্সবাজার এলাকায় ৩০,০০০ হেক্টর। বাকি আরো প্রায় ৮০,০০০ হেক্টর জমি চিংড়ি চাষের উপযোগী।

১৬) বাংলাদেশের পায় ২৫টি জেলায় ৮৪০ হেক্টর জমিতে গলদা চিংড়ির একক চাষ করা হচ্ছে।

১৭) বর্তমানে ধানক্ষেতেও গলদা চিংড়ির চাষ শুরু হয়েছে। ধানক্ষেত থেকে হেক্টরপ্রতি ২০০ থেকে ৪০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব।

১৮) উপকূলীয় জলাশয় ছাড়াও বাংলাদেশের নদীনালা, খালবিল, পুকুর, ডোবা, দিঘিতেও চিংড়ি চাষের সম্ভাবনা রয়েছে।

১৯) চিংড়ির পোনা ধরার কাজে আমাদের দেশের ২-৫ লক্ষ লোক এবং উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ১.৫-২ লক্ষ লোক নিয়োজিত আছে।

২০) চিংড়ি খাদ্য হিসেবে সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করায় বিশ্ববাজারে এর চাহিদা এবং মূল্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিংড়ি আজ তাই বাংলাদেশে এক বিরাট শিল্পরূপে পরিচিতি লাভ করছে। সুতরাং বলা যেতে পারে, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন তথা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি চাহিদা

পূরণসহ বহুবিধ ক্ষেত্রে চিংড়ি চাষের খুবই উজ্জ্বল সম্ভাবনা এদেশে বিদ্যমান ।

Post a Comment

Previous Post Next Post

ads

ads