🎯 জি আই পণ্য কী?
▪️জিআই এর পূর্ণরূপ গ্লোবাল আইডেন্টিফিকেশন (Geographical Indication)। অর্থাৎ একটি পণ্যকে ভৌগোলিকভাবে চিহ্নিত হতে হবে। কোনো একটি দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
▪️বলা যায় পুরো বিশ্বের কাছে যে পণ্যের মাধ্যমে একটি দেশ বা অঞ্চল বা সংস্থা পরিচিতি পাবে, সেটিই হচ্ছে জি আই পণ্য।
▪️গত শতাব্দীর বিশের দশকে ইউরোপে প্রথম এর ভাবনা আসে কোনো একটি পণ্য বা সংস্কৃতির অথেনটিক বা বিশুদ্ধ অবস্থার সন্ধানে। কোনো একটি পণ্য বা সংস্কৃতি আসলে কোথা থেকে শুরু হয়েছিল এই উৎসমূলটা খুঁজে বের করতে পারলে, তাদের বিশুদ্ধ অবস্থা এবং পরবর্তী ক্রমবিকাশটা ধরা সহজ হয়।
▪️কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে ঐ পণ্যটিকে অন্য দেশের সমজাতীয় পণ্য থেকে আলাদাভাবে চেনা যায়। পণ্যের বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয় এবং এই পণ্যের আলাদা রেপুটেশন তৈরি হয়। বিশ্ববাজারে উৎপদনকারীরা পণ্যের জন্য ভালো দাম পান। জি আই পণ্যের নির্দিষ্টঅঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়।
🎯 জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেলে সুবিধা কী কী?
১. সংশ্লিষ্ট পণ্যের মালিক হবে সেই দেশ। ভৌগোলিক পরিচিতও পাবে সেই দেশ।
২. তারা সেই পণ্যের ব্যবসায়িক মুনাফার সম্পূর্ণ অংশের মালিক হবেন।
৩. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এসব পণ্যের মালিকানা বা স্বত্ব আর কোনো দেশ দাবি করতে পারবে না।
৪. দেশের মধ্যেও অন্য কোনো এলাকার জনগোষ্ঠী এ পণ্যের মালিকানা পাবে না!
🎯 রসগোল্লার জি আই স্বীকৃতি ভারতের তার মানে আমরা কি রসগোল্লা আর বানাতে পারবোনা??
▪️শুধু রসগোল্লা না, বাসমতি চাল, নকশি কাঁথা, এমনকি রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ অনেক পণ্যকেই জিআই হিসেবে নিয়ে নিয়েছে ভারত।
▪️রসগোল্লা বানাতে আপাতত সমস্যা নেই। কিন্তু ২০৩০ সালের পর ভারত অনুমতি না দিলে বানাতে পারবোনা। কারণ ২০৩০ সালের পর থেকে জি আই স্বীকৃতি প্রাপ্ত পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রির জন্য জিআই পাওয়া দেশের অনুমতি লাগবে।
▪️আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা World Intellectual Property Organization (WIPO) সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ২০২৫ সাল থেকে এইসব ব্যাপার কড়াকড়িভাবে আরোপ করা হবে। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে তা পিছিয়ে ২০৩০ সালে নেওয়া হয়েছে। আবার এই আইন মধ্যম আয়ের দেশের জন্য যতটা কড়াকড়ি ততটা স্বল্প আয়ের দেশের জন্য নয়।
▪️যেহেতু আমরা নিজেদের ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ দাবি করছি, জিআইসহ অন্যান্য কপিরাইটের ব্যাপারে আমাদের কড়াকড়িভাবে আইন মানতে হবে। অর্থাৎ ভারতকে নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ প্রদান করে বা কূটনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ রসগোল্লা বানাতে পারবে।
🎯 জি আই পণ্যের স্বীকৃতি দেয় কে?
▪️World Intellectual Property Organization (WIPO)-র নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) এই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।
▪️জিআই পণ্যের নিবন্ধনের জন্য কোনো ব্যক্তি, সংঘ, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে আবেদন করতে হয় Department of Patents, Designs and Trademarks (DPDT) তে। ওই পণ্যটি কেন জিআই পাওয়ার উপযুক্ত, সে সম্পর্কিত পর্যাপ্ত প্রমাণ ও তথ্য-উপাত্ত সংযুক্ত করতে হয় আবেদনের সঙ্গে।
পণ্য জিআই হতে গেলে পণ্যের অন্তত ৫০ বছরের ঐতিহ্য থাকতে হয়, যে এলাকার পণ্য তার স্বীকৃতি থাকতে হয়। ঐতিহাসিক দলিল–দস্তাবেজই শুধু নয়, প্রাচীন সাহিত্য-পুঁথি-ছড়ায় কোনো উল্লেখ থাকলেও প্রমাণ হিসেবে তা তুলে ধরা হয়।
▪️আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর তা যাচাই বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে DPDT। আবেদনের মধ্যে কোনো ভুল থাকলে তা পরিবর্তন বা সংশোধনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয় আবেদনকারীকে। এইসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আবেদনটি গ্রহণযোগ্য মনে করলে DPDT সেই আবেদন প্রকাশ করে জিআই জার্নালে (Bangladesh Government Press & DPDT) ওয়েবসাইটে। এরপর ২ মাস করে অপেক্ষা করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে ওই পণ্যের আবেদনকে চ্যালেঞ্জ বা সেই আবেদনের বিরোধিতা করার সুযোগ থাকে।
▪️বিরোধিতা বা চ্যালেঞ্জ হলে সেটি বিবেচনায় নিয়ে আবেদন নতুন করে পর্যালোচনা করা হয়।
বিরোধিতা গ্রহণযোগ্য হলে আবেদন বাতিল করা হয়। আর তা না হলে কিংবা কোনো বিরোধিতা না থাকলে ২ মাস পর ওই পণ্যটিকে জিআই সনদ দেওয়া হয়, যা তার জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্তির চূড়ান্ত ধাপ। এ সময় পণ্যটি জিআই স্বীকৃতি পেয়ে যায়।
🎯 বাংলাদেশে জিআই পণ্যের স্বীকৃতির কী অবস্থা?
▪️জিআই পণ্য স্বীকৃতি সংক্রান্ত TRIPS চুক্তি বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে ১৯৯৫ সালে। ঠিক একই বছর ভারতও এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ভারত পরের বছরই নিজেদের দেশে জিআই আইন প্রণয়ন করে। ভারত জি আই নিয়ে বিপুল গবেষণা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন পণ্যে জিআই দাবি করতে থাকে।
▪️বাংলাদেশ ২০১৩ সালে আইন প্রণয়ন করে। ততদিনে ভারত ১০৮টি পণ্যের ওপর জিআই অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। বর্তমানে ভারতের জিআই পণ্য ৪৩০ এরও বেশি। সর্বোচ্চ জিআই ট্যাগপ্রাপ্ত দেশ হলো জার্মানি (জিআই পণ্যের সংখ্যা ষোল হাজারেরও বেশি)।
▪️জামদানি বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ১৭ নভেম্বর ২০১৬ সালে স্বীকৃতি পায়। এরপর একে একে জিআই পণ্য হয় বাংলাদেশের ইলিশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম, বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুর কাটারিভোগ ও কালিজিরা চাল, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, ঢাকাই মসলিন, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি ও শীতলপাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলশীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম ও আশ্বিনা আম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম, কুমিল্লার রসমালাই এবং কুষ্টিয়ার তিলের খাজা।
▪️বর্তমানে বাংলাদেশের জিআই পণ্য ২১টি। এছাড়াও বাংলাদেশের মোট ১৪টি পণ্যের জন্য নতুন করে আবেদন জমা পড়েছে এবং আবেদনের প্রক্রিয়ার মাঝে আছে আরও দু’টি পণ্য।
🎯 আপনার এলাকার কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতি পেতে আপনি কী করতে পারেন?
▪️আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একটা ফর্ম আছে। সেই ফর্মটি ডাউনলোড করে আপনারা আপনাদের নিজের এলাকার ঐতিহ্য নিয়ে বিশদে লিখতে পারেন। সরকারের পক্ষে দেশের কোনায় কোনায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। জনগণ যদি এই তথ্যগুলো দিতে পারে, তবে গবেষকরা সেই তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে এই বিপুল কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নিতে পারেন।
Post a Comment